Fri. Apr 26th, 2024

যে কোন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মাধ্যমিক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে। শিক্ষার ভিত্তি পোক্ত করার পাশাপাশি সুনাগরিক গড়ে তোলার কাজটিও মাধ্যমিক শিক্ষা করে থাকে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে সুনির্দিষ্ট দক্ষতা পূর্ণ শিক্ষার্থী পাঠানোর দায়িত্বে ও রয়েছে মাধ্যমিক শিক্ষা। সেহেতু এটা বলা অত্যুক্তি হবেনা যে, মাধ্যমিক শিক্ষার গুনগতমান দেশের উচ্চ শিক্ষায় প্রভাব ফেলছে।

আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষার উপর যে ধরনের গুরুত্ব দেওয়া হয় সেটা মাধ্যমিক শিক্ষায় দেওয়া হয়না। অথচ জরুরী জীবন দক্ষতাগুলো শিক্ষার্থী মাধ্যমিক স্তরেই পেয়ে থাকে। হরেক রকমের বিষয় মাধ্যমিক স্তরে অধ্যয়ন করার মাধ্যমে শিক্ষার্থী তার বহুমুখী বিকাশ নিশ্চিত করতে পারে। উচ্চ শিক্ষা স্তরে গিয়ে সে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে এবং সব মাধ্যমিক গ্রাজুয়েটদের উচ্চ শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন নেই।

ব্রিটিশ আমলে গড়ে ওঠা মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার খোল নলচে বদলে স্বাধীন দেশের উপযোগী করার উদ্যোগ তেমন ভাবে পরিলক্ষিত হয়নি। গতানুগতিকতার মারপ্যাঁচে এ দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে। উন্নত দেশ গড়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রচেষ্টা বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই মাধ্যমিক শিক্ষার যথাযথ উন্নয়নের দিকে সুনজর দিতে হবে।

বাংলাদেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো মাধ্যমিক স্তরে গুনগত শিক্ষা সেবা প্রদানের অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় স্তরে অবদান রেখে যাচ্ছে। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আরো দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য জাতি গড়ার কারিগর মাধ্যমিক শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। আসন্ন বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির ইলেকশন উপলক্ষে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের বিষয়টি জোরালো ভাবে আলোচিত হচ্ছে। সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন নিশ্চিত কল্পে নিন্মলিখিত পদক্ষেপ সমূহ গ্রহণ করা দরকারঃ

১. বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষকদের সেকেন্ড ক্লাশ গেজেটেড অফিসার হিসেবে বেতন-ভাতা অনুমোদন করেন। কিন্তু পরের দশকগুলোতে শিক্ষকদের বঞ্চিত করার মানসে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। যে পদগুলো আশির দশকে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সমমানের ছিল সেগুলো আজ প্রথম শ্রেণির পদে রুপান্তরিত হয়েছে। অন্যদিকে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভাগ্য গত চার দশকেও খোলেনি। গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি তারিখে সহকারী শিক্ষকদের চাকরির ০৮ বছর পূর্ণ হলে মাত্র ৫০% শিক্ষককে প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত করার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এটি ১০০ ভাগ হলে শিক্ষকদের জন্য সুখকর হতো। সরকারি মাধ্যমিকের প্রকৃত উন্নয়ন চাইলে এন্ট্রিতে ই সহকারী শিক্ষকদের প্রথম শ্রেণী দিতে হবে।

২. জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র সরকার ২০১০ সালে দেশের বিজ্ঞজন সহযোগে জাতীয় শিক্ষা নীতি ঘোষণা করেছেন। এই শিক্ষা নীতি অনুযায়ী মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যাপ্তি নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অদ্যাবধি নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি একই প্রতিষ্ঠানের অধীনে আনা হয়নি। গতানুগতিক ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির বেড়াজালে এখনো বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষা বন্দী। উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্ব দরবারে মাথা তুলে দাড়াতে হলে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কাঠামোর মধ্যে অনতিবিলম্বে আনতে হবে এবং সেই সাথে অষ্টম শ্রেণি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠাতে হবে।

৩. বিরাট মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা এখন উচ্চ শিক্ষার সাথে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। মাধ্যমিক স্তরে যারা পড়ানোর জন্য নিয়োগ প্রাপ্ত নয় এবং যারা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিজেদের চেয়ে নিচের স্টাটাস সম্পন্ন হিসেবে দেখেন তারাই মাধ্যমিকের নিয়ন্তা। ফলে সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের পেশাগত ন্যায্য সুবিধা ও সময়মতো পাওয়া যায়না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আদালতের শরনাপন্ন হওয়া লাগে। একজন শিক্ষক যদি তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত থাকেন, তাহলে তার পড়ানোর স্টামিনা আসবে কিভাবে? অন্যদিকে প্রাথমিক স্তরে পৃথক অধিদপ্তর থাকার ফলে টাইমস্কেল এবং সিলেকশন গ্রেডের মতো পেশাগত ন্যায্য পাওনা নিয়ে কোন অসুবিধা নেই। ফলে মাধ্যমিক শিক্ষা উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে পৃথক অধিদপ্তর।

৪. সম্প্রতি তিনশতের অধিক বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় জাতীয়কৃত হয়েছে। জাতীয়করণ কৃত বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সরকারি মাধ্যমিকে প্রবেশের ফলে নতুন সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। সামরিক শাসনামলের বাতিল বিধিমালায় বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আত্মীকরন সরাসরি নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষকদের পদোন্নতির সম্ভাবনা তিরোহিত করেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির কাজ হবে- কলেজের অনুরূপ নতুন আত্মীকরণ বিধিমালা প্রনয়ণ করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া। জাতীয়করন হওয়া শিক্ষকদের ওয়ান স্টেপ ডাউন করলে সমস্যা মিটবে।

৫. সরকারি মাধ্যমিকে সুষ্ঠু বদলি নীতিমালা দরকার। একই বিদ্যালয়ে বছরের পর বছর থাকার ফলে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে এবং বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ বেড়েই যাচ্ছে।

৬. শিক্ষক যত জ্ঞানী হবেন ততোই শিক্ষার্থীদের মংগল হবে। সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের এমফিল এবং পিএইচডি করার সুযোগ দিতে হবে। অন্যান্য বিভাগের মতো বিদেশে উচ্চ শিক্ষা নেওয়ার সুযোগও সৃষ্টি করতে হবে।

৭. বাংলাদেশে মাধ্যমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোতে মাধ্যমিক শিক্ষকেরা অনেকটা অচ্ছুৎ হিসেবে থাকেন। এসব প্রকল্পগুলোতে পেশাগতভাবেই মাধ্যমিক শিক্ষকদের অগ্রাধিকার থাকা উচিত। যারা মাধ্যমিকে পড়ান তাদের অন্তর্ভুক্ত না করলে এসব প্রকল্প টেকসই হবেনা।

৮. মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রশাসনে সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের দীর্ঘ শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো উচিত। যাদের মাধ্যমিক স্তরে পাঠদানের অভিজ্ঞতা নেই তারা এ সব পদে গেলে শিক্ষার অসময় আসতে দেরি হবে না।

৯.সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের সুনির্দিষ্ট পদসোপান নেই। তীব্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে চাকরি পেয়েও দীর্ঘ দিন পরে পদোন্নতি হয় এবং অনেকের ভাগ্যে তা জোটেনা। ফলে সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের ভেতর বঞ্চিত হওয়ার বোধ কাজ করে। সরকারের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট পদসোপান সৃষ্টি করা সময়ের দাবি।

এ সব যুগোপযোগী দাবিগুলো নিয়ে বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির ইলেক্টেড ব্যক্তিবর্গ কাজ করবেন এবং মাধ্যমিক শিক্ষাকে সুবিন্যস্ত ভাবে এগিয়ে নেবেন এই প্রত্যাশা সহস্রাধিক মাধ্যমিক শিক্ষকবৃন্দের।

মোস্তফা কামাল মোল্লা (৩৪ তম বিসিএস নন ক্যাডার)

সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি), শেখ হাসিনা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, গোপালগঞ্জ।

১২.১০.১৯

Mostofa Kamal Molla

Leave a Reply

Your email address will not be published.