বাংলাদেশে মাধ্যমিক শিক্ষা একটি সতন্ত্র ধারা হিসেবে ব্রিটিশ সরকারের আমলে গড়ে ওঠে। মাধ্যমিক শিক্ষা প্রাথমিক ও উচ্চ শিক্ষার মাঝখানে অবস্থিত একটি গুরুত্ব পূর্ণ স্তর। প্রাথমিক শিক্ষার ভিত মজবুত হয়ে ওঠে মাধ্যমিক স্তরে। অন্যদিকে উচ্চ শিক্ষা নেওয়ার জন্য দক্ষ শিক্ষার্থী গড়ে তোলার কাজটিও মাধ্যমিক শিক্ষা করে থাকে। আবার অনেক শিক্ষার্থীর কাছে মাধ্যমিক প্রান্তিক শিক্ষা হিসেবে পরিগনিত হয়। কারণ তারা এ স্তরের শিক্ষা শেষ করে পেশাগত জীবনে প্রবেশ করে থাকে।
মাধ্যমিক শিক্ষা একটা মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ স্তরের শিক্ষা হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ হলো এ স্তরে শিক্ষার্থীর উচ্চতর চিন্তন দক্ষতা ক্রমান্বয়ে পরিস্ফুটিত হতে থাকে। শিক্ষার্থীর আবেগীয় দিকগুলোকে সঠিক পরিচালনের মাধ্যমে তাদেরকে দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ এই মাধ্যমিক স্তরেই আছে। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের একটি উক্তি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। গনতন্ত্রের সবচাইতে জনপ্রিয় সংগা প্রদানকারী এই খ্যাতিমান আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ‘ Teach the children and It will not be necessary to teach the adults.’ শিশুদের মানসপটে যদি সঠিক শিক্ষার বীজ বপন করা যায় তাহলে বড় হয়েও তারা তাদের উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা নিয়ে এগিয়ে যাবে।
আমাদের দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা গতানুগতিক ভাবে চলছে। বিরাট আকার বিশিষ্ট এ সেক্টরে বিপুল সংখ্যক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু এটি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে উচ্চ শিক্ষার সাথে এবং একই অধিদপ্তরের অধীনে। ফলে নানাবিধ পেশাগত সমস্যার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে মাধ্যমিক শিক্ষা। কলেজ শিক্ষকদের কাজের ধরন মাধ্যমিক শিক্ষকদের চেয়ে ভিন্ন। দুটি সেক্টর ভিন্ন ধরনের এপ্রোচ দিয়ে পরিচালিত হয়। মাধ্যমিক শিক্ষকরা পেডাগজি নিয়ে কাজ করেন।অন্যদিকে কলেজ শিক্ষকরা এন্ডাগজি নিয়ে কাজ করেন। কাজের ধরণ পুরোপুরি আলাদা। কিন্তু মাধ্যমিকের উপরের পদগুলোতে কলেজ শিক্ষকরা অবস্থান করছেন এবং যে সেক্টরে তারা পড়ান না সেই সেক্টর নিয়ে তারা বিভিন্ন গাইডলাইন দিয়ে থাকেন। যিনি মাধ্যমিকের শ্রেণীতে পড়াচ্ছেন তার তো মাধ্যমিক সম্মন্ধে বাস্তব জ্ঞান থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে উল্টো নিয়ম চলছে। মাধ্যমিকের প্রাণ তার শিক্ষকেরা। কিন্তু এই শিক্ষকেরা তাদের সেক্টরের পলিসি মেকার নন। ফলে বাস্তবতা ও নিয়ম-নীতির মধ্য ফারাক বেড়েই চলছে। এর খেসারত দিতে হচ্ছে জাতিকে। প্রায়শই আলোচিত হচ্ছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর কোন আন্তর্জাতিক র্যাংকিং এ স্থান না পাওয়ার বিষয়টি। আসলে গোড়ায় যদি গলদ রয়ে যায় যতই উপরে যাওয়া হোক না কেন তেমন কোন লাভ হয় না।
সরকারি মাধ্যমিকের বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা আশার সঞ্চার করেনা। উচ্চ শিক্ষার সাথে থাকার কারণে মাধ্যমিকের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ প্রায়শই করা হয়। অধিদপ্তর যারা চালান তারা তাদের সুবিধা দেখবেন এটাই তো প্রকৃতিগত নিয়ম। ফলশ্রুতিতে সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকরা পদন্নোতি বঞ্চিত থাকেন জীবনের অধিকাংশ সময়ে। তাছাড়া পেশাগত সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্য উচ্চ আদালতের দারস্থ হওয়া লাগে। একটা গ্রেডেশন লিস্ট দেখার জন্য সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের করতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। আবার ২০/২৫ বছর চাকরি করেও সহকারি শিক্ষকের তকমা লাগিয়ে ঘুরতে হয়। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে সরকারি ও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত সংস্কার অতীব প্রয়োজনীয়। কিন্তু অধিদপ্তর তো আর শুধু মাধ্যমিকের নয়। এ বিষয়ে নজর দেওয়ার ফুরসত নেই অধিদপ্তরের। এই পরিস্থিতিতে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর স্থাপন অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে। সরকার যত দ্রুত এটি বুঝবে তত দ্রুত মাধ্যমিক শিক্ষার প্রকৃত উন্নয়ন রচিত হবে।
জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে প্রথমেই দরকার গুণগত শিক্ষা। শিক্ষার্থীরা যদি গুণগত শিক্ষা না পায় তাহলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী মানব সম্পদ আমরা গড়ে তুলতে পারবো না। সংগত কারনেই সরকারের উচিত হবে পৃথক মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করে গুনগতমান সম্পন্ন শিক্ষা সেবা প্রদানের ব্যাপারে এগিয়ে আসা এবং মাধ্যমিক শিক্ষার কাঠামোগত উন্নয়ন সাধন করা। সেটি করতে পারলেই কেবল ২০৪১ সালের মধ্য একটি উন্নত দেশ গড়ার ক্ষেত্রে আমরা একধাপ এগিয়ে যাবো।
মোস্তফা কামাল মোল্লা,
সহকারী শিংক্ষক, (ইংরেজী),
শেখ হাসিনা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজ, গোপালগঞ্জ
06.07.2019
গোপালগঞ্জ।